শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আমাদের বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তাহলে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কীভাবে বাড়বে? জেনে নিন সুপরিচিত ডাক্তার জ্যোতি রঞ্জন পরিড়ার পঞ্চসূত্রী ফর্মুলা। 

coronavirus

করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাস এখন সমগ্র বিশ্বের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রে যত সংখ্যায় জীবনহানির অনুমান করা হয়েছিল, বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সাধারণতঃ যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তারাই বেশি করোনভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে। ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের এবং যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ফুসফুসের রোগের মতো বিভিন্ন দূরারোগ্য অসুস্থতা আছে, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। সেই ব্যক্তির করোনাভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি এবং কেউ কেউ মৃত্যুর কবলেও পড়ছেন। 

আসুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায়। তার আগে আমাদের জানতে হবে যে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী? 

immunity power in body

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কী? (What is Immunity Power in Bangla)

মানুষের রক্তে “শ্বেত রক্তকণিকা” নামের একটি কোষ থাকে। এই শ্বেত রক্তকণিকা হল আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা বাহিনী। যখনই কোনও জীবাণু বা ভাইরাস আমাদের শরীরে আক্রমণ করে, এই শ্বেত রক্তকণিকাগুলি তার রাস্তা আটকে সেটির বিরুদ্ধে লড়াই করে। সুতরাং, শ্বেত রক্তকণিকাকে আমাদের শরীরের যোদ্ধাও বলা হয়। 

আমাদের শরীরের হাড়ের মধ্যে থাকা অস্থি মজ্জা (Bone Marrow) এই শ্বেত রক্তকণিকা তৈরি করে। শরীরের থাইমাস গ্রন্থি এই শ্বেত রক্তকণিকাকে মজুত করে এবং প্রশিক্ষণ দেয়। এটিকে কার্যক্ষম করতে প্লীহা, যকৃত ইত্যাদি অঙ্গ সাহায্য করে। এই সবগুলিকে একসাথে যুক্ত করে আমরা বলতে পারি যে এটি একটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এর কাজ করার পদ্ধতিকে আমরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বলি। 

প্রতিরোধ ব্যবস্থা কখনই রাতারাতি বাড়বে না। এছাড়াও, বাজার উপলভ্য ইমিউনিটি বুস্টারের মতো ওষুধ খেলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে না। তাই আপনি কোনও ওষুধ খেয়ে চটপট আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারবেন না। আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে আপনাকে নিয়মিতভাবে জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাস উন্নত করতে হবে। 

আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জানুন আমাদের পঞ্চসূত্রী ফর্মুলা। আপনার দৈনন্দিন জীবনে এই ফর্মুলা প্রয়োগ করলে আপনার স্বাস্থ্য আরও শক্তিশালী হবে এবং করোনার মতো ভাইরাস বা জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। 

food for immunity

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার পঞ্চসূত্রী ফর্মুলা (Formula for boosting immunity in Bangla)

১. সুষম খাদ্য খান 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য থাকা শ্বেত রক্তকণিকা জীবাণু বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কেমোকাইন, সাইটোকাইন, অ্যান্টিবডি ইত্যাদি রাসায়নিক ব্যবহার করে। এগুলি যাতে কাজ করতে পারে তার জন্য আমাদের এমন কিছু খাদ্যের প্রয়োজন সেগুলিকে আমরা মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট বলে থাকি। মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট যেমন সেলেনিয়াম, কপার আয়রন, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-ডি, ভিটামিন-বি৬ এবং ফলিক অ্যাসিড। তাজা ফল এবং শাকসব্জী বেশি পরিমাণে খেলে শরীরে এই মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ হয়। 

আঙ্গুর, কমলালেবু, পাতিলেবু, ব্রোকলি, লাল ক্যাপসিকাম ইত্যাদি থেকে আপনি বেশি পরিমাণে ভিটামিন-সি পাবেন। বাদাম তেল এবং অ্যাভোকাডো খাওয়ার ফলে বেশি পরিমাণে ভিটামিন-ই পাওয়া যাবে একইভাবে নিয়মিত দই বা দুধ খেলে আপনার শরীরে ভিটামিন-ডি আসে। আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে আপনার এই ধরণের সুষম খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। আপনাকে জাঙ্ক ফুড থেকে দূরে থাকতে হবে। 

২. নিয়মিত শরীরচর্চা করুন 

আমাদের শরীরে দুই ধরণের স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে। সংবেদী (সিমপ্যাথেটিক) স্নায়ুতন্ত্র এবং উপ-সংবেদী (প্যারা-সিমপ্যাথেটিক) স্নায়ুতন্ত্র। কর্মক্ষেত্রে কাজ করার সময় বেশিরভাগ মানুষ মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। যার ফলে এই স্নায়ুগুলি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না। আমরা নিয়মিতভাবে যোগব্যায়াম বা প্রাণায়াম করে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারি। 

অনুলোম-বিলোমের মতো দীর্ঘায়িত শ্বাসপ্রশ্বাসের প্রাণায়াম করলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ভালভাবে কাজ করে। সুতরাং, নিয়মিত যোগব্যায়াম বা প্রাণায়াম করেন এমন মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। 

proper sleep

৩. ঘুমের উপর সংযম নিয়ে আসুন 

প্রতি রাতে আপনার ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। ঘুমানোর আগে কোনও ইলেক্ট্রনিক্স জিনিষ ব্যবহার করবেন না। ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে মোবাইল বা টিভি দেখবেন না। রাতে হালকা খাদ্য খান। 

একইভাবে চা, কফি, চকোলেট, মদ এড়িয়ে চলুন। গবেষণায় দেখা গেছে যে ঘুমের সময় আমাদের শরীরে বিভিন্ন হরমোন এবং রাসায়নিক উপাদান নিসৃত হয় যেগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। 

৪. চাপমুক্ত থাকুন 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সঠিকভাবে কাজ করার জন্য আপনাকে মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকা দরকার। আমরা চাপমুক্ত থাকলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালভাবে কাজ করতে পারে। চাপগ্রস্ত হলে এর ক্ষমতা কমে যায়। করোনার কারণে অনেকেরই মানসিক অবস্থা ভাল নেই। সুতরাং, এই সময়ে পরিবারের সাথে সময় কাটান ও নিজেকে খুশি রাখার চেষ্টা করুন। 

৫. ধূমপান ও মদ্যপান থেকে দূরে থাকুন 

আমাদের শ্বাসনালীতে সিলিয়া নামক একটি অঙ্গ রয়েছে যেটি ঝাঁটার মতো দেখতে হয়। আমরা শ্বাস নেওয়ার সময় বায়ুতে থাকা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ জীবাণু নাক দিয়ে শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে ও সেগুলিকে সিলিয়া ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করে দেয়। তবে নিয়মিত ধূমপান সিলিয়া এবং ফুসফুসের কোষগুলিকে ক্ষতি করতে পারে। যার ফলে সেগুলি ব্যাকটিরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

একইভাবে, মদ্যপান করলে তা আমাদের পাকস্থলীতে থাকা উপকারী জীবাণু মেরে ফেলে। যার ফলে ক্ষতিকারক জীবাণুর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে রোগের কারণ হয়। তাই আমরা যদি ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে দূরে থাকি তাহলে আমরা আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে পারি। 

উপরোক্ত ৫টি ফর্মুলা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োগ করতে পারলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এছাড়াও, আমরা আক্রমণকারী জীবাণু এবং ভাইরাসগুলির বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করতে পারব। 

cold and cough

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার লক্ষণ (Symptoms of low immunity in Bangla)

ছোট বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দেয়; 

– বার বার ঠান্ডা লাগবে 

– নিউমোনিয়া হতে পারে 

– কানে সংক্রমণ হবে ও পুঁজ বেরোবে 

– ঘন ঘন জ্বর আসবে 

– ঘন ঘন ডায়রিয়া হবে 

ছোট বাচ্চারা বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আমরা বুঝব যে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। 

অন্যদিকে, বয়স্ক ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসের মতো দূরারোগ্য অসুস্থতা থাকলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। একইভাবে, শরীরচর্চার জন্য জিমে যাওয়া অনেক মানুষ স্টেরয়েড গ্রহণ করেন। এই ওষুধ অনেকদিন ধরে ব্যবহার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে, ঘন ঘন জ্বর, কাশি, সর্দি ইত্যাদি লেগে থাকে এবং নিয়মিত ওষুধ খেলেও সারে না। 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হতে কত দিন লাগে (How long does it take to improve immunity in Bangla)

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একটি জটিল প্রক্রিয়া। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে ও শরীরচর্চা না করলে যেমন আমাদের ওজন বেড়ে যায় এবং শরীরচর্চা না করলে আমাদের ওজন কমে যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিন্তু ওজন কমানো বা ওজন বাড়ানোর মতো কোনও সাধারণ প্রক্রিয়া নয়। আমরা রাতারাতি আমাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারি না। খাদ্য ও পানীয় সঠিক থাকলে এবং সঠিকভাবে শরীরচর্চা করলে ভবিষ্যতে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হতে পারে। 

এটি হল একটি অভ্যাস, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দু-একদিনে বাড়বে না। সুষম খাদ্য খাওয়া, শরীরচর্চা করা, ঘুমের উপর সংযম নিয়ে আসা, চাপমুক্ত থাকা, মদ্যপান ও ধূমপান এড়ালে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হয়। যার ফলে আপনি নিরোগ থাকবেন, ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা কমবে এবং করোনার মতো ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন।