থাইরয়েডের রোগের প্রকার, লক্ষণ এবং চিকিৎসা সম্পর্কে সুপরিচিত বিশেষজ্ঞ ডাঃ অভয় কুমার সাহু কী বলেন? আসুন জেনে নিই। 

thyroid

থাইরয়েড গ্রন্থিটি আমাদের গলায় রয়েছে। আমাদের শরীরের সব ক্রিয়াকলাপ থাইরয়েড হরমোনের উপর নির্ভর করে। আমাদের মাথার চুল থেকে শুরু করে নখ পর্যন্ত সব কিছুই থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। থাইরয়েডের রোগ সব বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা যায়। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। এটি একটি অটোইমিউন রোগ। 

আসুন জেনে নেওয়া যাক থাইরয়েডে কী ধরণের রোগ হয়, এই রোগের লক্ষণগুলি কী? 

থাইরয়েডে দুই ধরণের রোগ হয়। 

হাইপো-থাইরয়েডিজম – থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ কম হলে, সেই অবস্থাকে হাইপো-থাইরয়েডিজম বলা হয়। 

হাইপার-থাইরয়েডিজম – থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থাইরয়েড হরমোনের ক্ষরণ বেশি হলে, সেই অবস্থাকে হাইপার-থাইরয়েডিজম বলা হয়। 

থাইরয়েডের রোগ হাইপো হোক বা হাইপার, সেটা পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। 

হাইপো-থাইরয়েডিজমের লক্ষণ 

হাইপো-থাইরয়েডিজম যেকোনও বয়সে হতে পারে। জন্ম থেকে গর্ভাবস্থা এবং এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও এই রোগ দেখা দিতে পারে। 

thyroid_2

জন্ম থেকেই হাইপো-থাইরয়েডিজম হলে বাচ্চাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে: 

  • বাচ্চারা বোকা হয়ে যায় 
  • বাচ্চার বুদ্ধির বিকাশ হয় না, নির্বোধ হয়ে যায় 
  • বেঁটে হয় 
  • পড়াশোনায় দুর্বল হয়ে যায় 
  • বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা হয় 
  • নবজাতকের নাভি ফুলে ওঠে 
  • জন্মের পর জন্ডিস হয়ে যায় 
  • ত্বক শুষ্ক হয়ে যায় 

৪-৫ বছর বয়সে হাইপো-থাইরয়েডিজম হলে: 

  • উচ্চতা বাড়বে না 
  • পড়া মনে রাখতে পারবে না বা বাচ্চা নির্বোধ হয়ে যাবে 
  • স্মৃতিশক্তি কমে যাবে 
  • কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দেখা দেয়। 

১৫ থেকে  বছর বয়সী মেয়েদের হাইপো-থাইরয়েডিজম হলে: 

  • ঋতুস্রাবের উপর প্রভাব পড়ে 
  • ওজন বেড়ে যায় 
  • কোনও কাজে মন লাগে না 
  • সবসময় ঘুম আসে 
  • অবসন্নতা 
  • একাগ্রতা কমে যায় 

৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সের লোকদেরও থাইরয়েডের রোগ থাকলে এই লক্ষণগুলি দেখা দেয়। এছাড়া স্মৃতিশক্তিও কমে যায়। 

হাইপো-থাইরয়েডিজমের রোগী যদি দীর্ঘ সময় ধরে ওষুধ গ্রহণ না করেন তাহলে হৃৎপিণ্ডের চারপাশে জল জমে যায় (পেরিকার্ডিয়াল ইফিউশন), ফুসফুস এবং পাকস্থলীতে জল জমে যায় (প্লিউরাল ইফিউশন)। এই সব সমস্যা দেখা দেওয়ার পরেও ডাক্তারের সাথে পরামর্শ না করলে এবং ওষুধ না খেলে এনসেফালোপ্যাথি বা মস্তিষ্কের সমস্যা সৃষ্টি হয়। 

hypothyroidism

হাইপো-থাইরয়েডিজমের পরীক্ষা 

থাইরয়েডের সমস্যা আছে কিনা তা T3, T4, TSH পরীক্ষা থেকে জানা যায়। এই পরীক্ষা দেখায় যেকোনও ব্যক্তির হাইপো-থাইরয়েড রয়েছে কিনা। যদি পরীক্ষায় দেখা যায় যে T3, T4 কম এবং TSH বেশি, তাহলে সেটিকে প্রাইমারি হাইপো-থাইরয়েডিজম বলে। 

কিছু লোকের থাইরয়েডের কোনও লক্ষণ নাও থাকতে পারে কিন্তু যদি পরীক্ষায় TSH ৮ থেকে ১০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে সেটিকে স্পন্টেনাস হাইপো-থাইরয়েডিজম বলে। 

হাইপো-থাইরয়েডিজমের চিকিৎসা 

কোনও ব্যক্তির অনেক বেশি TSH হলে তাকে অবিলম্বে ওষুধ খাওয়া শুরু করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে, TSH ১০ এর চেয়ে কম হলেও ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। TSH ১০ এর চেয়ে কম হলে থাইরয়েড পারক্সাইড অ্যান্টিবডিগুলি পরীক্ষা করা হয়। আপনার যদি উচ্চ মাত্রায় থাইরয়েড পারক্সাইড অ্যান্টিবডি থাকে তাহলে আপনার ওষুধ খাওয়া আবশ্যক। 

যদি কোনও মহিলার স্পন্টেনাস হাইপো-থাইরয়েডিজম হয় (TSH ১০ এর চেয়ে কম) তাহলে ডিম্বাশয়ে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম থাকে। এক্ষেত্রে মাকে থাইরয়েডের ওষুধ দেওয়া হয়। 

থাইরয়েড গ্রন্থি থাইরয়েড হরমোন তৈরি করা বন্ধ করে দিলে, এটি আর সারাজীবন তৈরি করতে পারে না। হাইপো-থাইরয়েডিজম থাকা ব্যক্তিদের সারা জীবন হরমোন ওষুধ খেতে হয়। 

থাইরয়েডের ওষুধের ব্যবহার 

থাইরয়েডের ওষুধ থেকে কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না। যদি কোনও ব্যক্তি থাইরয়েডের ওষুধটি সঠিক পরিমাণে, সঠিক উপায়ে এবং সঠিক সময়ে খান তাহলে সে তার সারাজীবন খেলেও তার কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। 

থাইরয়েডের ওষুধ সর্বদা বিছানা ছাড়ার সাথে সাথে খাওয়া উচিত। থাইরয়েডের ওষুধ খাওয়ার পরে এক ঘণ্টা জল ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া নিষিদ্ধ। আপনি যা খাবেন তা ওষুধ খাওয়ার এক ঘণ্টা পরে খেতে পারবেন। 

মনে করুন আপনি অন্য কোনও রোগের জন্য কিছু ওষুধ খাচ্ছেন এবং ডাক্তার আপনাকে খালি পেটে এটি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তাহলে আপনি থাইরয়েডের ওষুধ খাওয়ার এক ঘণ্টা পরে ওষুধটি খেতে পারেন। 

গর্ভবতী মহিলাদের সাধারণত গর্ভাবস্থায় আয়রন এবং ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে, থাইরয়েডের ওষুধ এবং ক্যালসিয়াম ও আয়রন খাওয়ার মধ্যে আরও ব্যবধান রাখা প্রয়োজন। থাইরয়েডের ওষুধগুলি সকালে নেওয়া যেতে পারে এবং ক্যালসিয়াম ও আয়রনের ওষুধ দুপুর বেলা খেতে পারেন। 

মানুষের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে আহার এবং শরীরচর্চা না করা থাইরয়েড রোগের কারণ হতে পারে। তবে থাইরয়েডের সাথে ডায়েট এবং শরীরচর্চার কোনও সম্পর্ক নেই। এটি একটি অটো ইমিউন ডিসঅর্ডার। থাইরয়েডের সমস্যাগুলি আমাদের শরীরে হরমোন পরিবর্তনের ফলে ঘটে। 

অতীতে, আয়োডিনের ঘাটতির কারণে থাইরয়েডিজম হত কারণ লোকেরা মোটা দানা বিশিষ্ট সাধারণ লবণ ব্যবহার করত। এখন লোকেরা আয়োডিনযুক্ত লবণ খাচ্ছে তাই লোকেরা লবণের সাথে আয়োডিন পেয়ে যাচ্ছে। এখন আয়োডিনের ঘাটতি নয়, অটোইমিউন রোগের কারণে থাইরয়েডিজম হচ্ছে। তাই থাইরয়েডিজমের জন্য জীবনযাত্রার পরিবর্তনের দরকার নেই। তবে হাইপো-থাইরয়েডিজম ওজন বাড়িয়ে তোলে। তাই ওজন কমাতে প্রতিদিন শরীরচর্চা করা আবশ্যক। 

thyroid_3

হাইপার-থাইরয়েডিজমের লক্ষণ 

হাইপো-থাইরয়েডিজমে যে লক্ষণগুলি হয়, হাইপার-থাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলি সেগুলির ঠিক বিপরীত। এর লক্ষণগুলি হল: 

  • ওজন কমে যাওয়া 
  • প্রচণ্ড খিদে লাগবে 
  • পর্যাপ্ত খাবার খেলেও আপনার ওজন কমতে থাকে 
  • ঘাম হয়, শীতকালেও অতিরিক্ত ঘাম হয় 
  • দিনে ৫ থেকে ৭ বার পায়খানা হবে 
  • অনেকের চোখের আকার বেড়ে যায় 
  • খিটখিটে হয়ে যাওয়া 
  • অল্প কথায় রেগে যাওয়া 
  • হাত ও পা কাঁপানোর মতো লক্ষণ দেখা দেয় 
  • এই সব লক্ষণগুলি হাইপার-থাইরয়েডিজমের লক্ষণ। 

হাইপার-থাইরয়েডিজমের চিকিৎসা 

হাইপার-থাইরয়েডিজমেও T3, T4, TSH পরীক্ষা করা হয়। এই ক্ষেত্রে T3, T4 বেড়ে যায় এবং TSH কমে যায়। বর্তমানে হাইপার-থাইরয়েডিজমের জন্য থাইরয়েড গ্রন্থি স্ক্যান করে থাইরয়েডের বিভিন্ন ধরনের রোগ সম্পর্কে জানা যায়। 

হাইপার-থাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে সারাজীবন ওষুধ খেতে হয় না। সাধারণত ২ থেকে ৩ বছর ধরে ওষুধ খেলে হাইপার-থাইরয়েডিজম সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাক। তবে কিছু লোকের ওষুধ খাওয়ার পরেও হাইপার-থাইরয়েডিজম সারে না। এই ক্ষেত্রে, রেডিও আয়োডিন থেরাপি দেওয়া হয়। 

কোনও মহিলার গর্ভে সন্তান থাকলে তাকে রেডিও আয়োডিন থেরাপি দেওয়া হয় না। এছাড়াও, কোনও ব্যক্তির গলগণ্ডের আকার বড় থাকলে রেডিও আয়োডিন ছাড়াই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ৯০ শতাংশ গ্রন্থি কেটে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিছু লোকের সম্পূর্ণ থাইরয়েড গ্রন্থি কেটে সরিয়ে দিতে হয়। যার ফলে হাইপো-থাইরয়েডিজম সেরে যায়। গ্রন্থি কেটে সরিয়ে দেওয়ার কারণে, থাইরয়েড হরমোনের জন্য থাইরয়েড হরমোন ওষুধ দেওয়া হয়। যার ফলে রোগী সারা জীবন সুস্থ থাকেন।